শনিবার ২২ নভেম্বর ২০২৫ - ১৬:২৫
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজা শিশুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে

“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজা শিশুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে”— গাজার শিশুদের ওপর ইসরায়েলি সহিংসতার নজিরবিহীন প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা নিয়ে একজন মার্কিন লেখক ও মানবাধিকার কর্মীর বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: গাজায় চলমান গণহত্যাকে বলা হচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত গণহত্যা। এর মূল কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—যেখানে কেবল একটি মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই কয়েক সেকেন্ডে সারা পৃথিবীতে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কথিত যুদ্ধবিরতির আড়ালেও গণহত্যা আজও অব্যাহত।

ফিলিস্তিনি সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই বছরের গণহত্যায় ইসরায়েল প্রায় সত্তর হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তবে অনেক অনুমানে বলা হচ্ছে প্রকৃত সংখ্যা তার দশ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এই নৃশংসতা সত্যিই বিস্ময়কর।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—এটি শিশুদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এনেছে। সেভ দ্য চিলড্রেন–এর ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমপক্ষে ২০,০০০ শিশুকে ইসরায়েল হত্যা করেছে। সেখানে আরও উল্লেখ আছে:

“নিহত শিশুদের মধ্যে কমপক্ষে ১,০০৯ জনের বয়স এক বছরের নিচে। এদের মধ্যে প্রায় ৪৫০ শিশু যুদ্ধ চলাকালীন জন্ম নিয়েছিল এবং জন্মের পরই নিহত হয়েছে। আরও অন্তত ৪২,০১১ শিশু আহত হয়েছে, এবং জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকার কমিটির হিসেবে ২১,০০০ শিশু স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। হাজারো শিশু এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ বা চাপা পড়ে আছে।”

যে কোনো বিবেকবান মানুষ এসব সংখ্যা দেখে হতবাক হবে।

কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:

“ইসরায়েলি বাহিনী সমগ্র গাজাজুড়ে বোমাবর্ষণ আরও তীব্র করেছে, ফলে ৯৭% স্কুল, ৯৪% হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণে শিশুদের মৃত্যুহার বয়স্কদের তুলনায় সাত গুণ বেশি। তাদের দেহ আঘাতের প্রতি বেশি সংবেদনশীল এবং তারা এমন ধরনের আঘাত পায় যা তাদের শারীরিক গঠন অনুযায়ী বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন।”

বেঁচে থাকা শিশুদের পরিস্থিতিও ভয়াবহ—তাদের মানসিক আঘাত তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি।

আল জাজিরা–র ৩১ অক্টোবরের রিপোর্ট বলছে: “গাজার ৮০%–এর বেশি শিশু এখন তীব্র ট্রমার উপসর্গে ভুগছে।”

প্রতিবেদনে কিছু শিশুর দুরবস্থা তুলে ধরা হয়েছে— একজন ১৫ বছর বয়সী ছেলে নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়রিয়া এবং কিডনি বিকলের মতো জটিলতায় ভুগছে; সবই সে যেসব ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছে তার ফল। আরেকজন ৮ বছর বয়সী লানা—যে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাদের বাড়ির ছাদ ধসে পড়ার পর বেঁচে যায়। ধোঁয়া ও রাসায়নিকের প্রভাবে তার শরীরে ভিটিলিগো হয়েছে, এবং সামান্য শব্দেও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।

ইউনিসেফ–এর ২৬ অক্টোবরের রিপোর্টে পরিস্থিতি এইভাবে সংক্ষেপ করা হয়েছে:

 “বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকায় টিকে থাকার প্রতিদিনের ভয়াবহতা প্রায় এক মিলিয়ন শিশু সহ্য করেছে—যা তাদের হৃদয়ে ভয়, ক্ষতি ও শোকের গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।”

এখন প্রশ্ন হলো— এই শিশুগুলোর প্রতি বিশ্বের দায়িত্ব কী? নিহত ২০,০০০ শিশুর প্রতি এবং হাজারো শিশু যারা আজীবন শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি বয়ে বেড়াবে?

মিডল ইস্ট মনিটর ১০ নভেম্বর লিখেছে:

“বিশ্বের প্রতিটি শিশুর সুরক্ষার কথা বলা হয়, কিন্তু গাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব। যেসব প্রতিষ্ঠান শিশুর অধিকারকে ‘সর্বজনীন’ বলে দাবি করে, তারা ফিলিস্তিনি শিশুদের বেলায় নির্বাক—আর এই নীরবতা শুধুই গাজাকে নয়, বিশ্বের সকল শিশুর ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলে।”

রিপোর্টটি আরও বলেছে:

“১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ গ্রহণ করে। সেখানে জীবনের অধিকার, সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—সব শিশুদের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু গাজায়—যেখানে প্রতিদিন ডজনখানেক শিশু নিহত বা আহত হয়—সেই ‘সর্বজনীন অধিকার’ কেবল কাগুজে স্লোগান হয়ে গেছে।”

লেখক যোগ করেন—এই অধিকার ভূগোলের পাশাপাশি বর্ণভেদেও ভিন্নভাবে প্রয়োগ হয়।

কানাডার উদাহরণ
লেখক বলেন—তিনি কানাডায় বাস করেন। কানাডা সরকার প্রথমে গাজা থেকে মাত্র ১,০০০, পরে ৫,০০০ শরণার্থী নেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এতদিনে ১,০০০–এরও কম মানুষ কানাডায় পৌঁছাতে পেরেছে—এবং তাদেরও অনেককে মানবপাচারকারীদের টাকা দিয়ে বের হতে হয়েছে।

এর বিপরীতে ইউক্রেনের শরণার্থী— কানাডা এখন পর্যন্ত ২,৯৮,১২৮ জন ইউক্রেনীয় নিয়ে এসেছে, এবং প্রায় ১০ লাখ আবেদন অনুমোদন করেছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে—

“যে শরণার্থী কানাডার প্রচলিত ধারণার সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ—অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ, পশ্চিমা, উদারনৈতিক—তাদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।”

অন্যদিকে যারা এই মানদণ্ডে ‘খাপ খায় না’, তাদেরকে “ভার”, “হুমকি” বা “অকৃতজ্ঞ” হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

অন্যান্য দেশের উদাহরণ
টাইমস কলোনিস্ট ২ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে: “ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় শিশু হাসপাতাল এক ভয়াবহ রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এক বছর পর পুনর্নির্মাণ করে দিচ্ছে কানাডিয়ান রেডক্রস।”


ইউএনডিপি ৪ এপ্রিল লিখেছে: “লাটভিয়ার আর্থিক সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত কিন্ডারগার্টেন ও শিশু হাসপাতাল পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।”

কিন্তু ফিলিস্তিনি শিশুদের বেলায় এসব দেশের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্র—শুরু থেকেই ফিলিস্তিনি গণহত্যায় ইসরায়েলের সহযোগী। আগস্টে তারা গাজা থেকে আগতদের সব ভিজিট ভিসা বাতিল করেছে। এর ফলে শত শত গুরুতর আহত শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে।

অক্সফাম ২৯ অক্টোবর জানায়: “কথিত যুদ্ধবিরতি থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজার জন্য মানবিক সহায়তার মাত্র অল্প অংশ ঢুকতে দিচ্ছে।”


মানবাধিকার সনদ
জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ বলে:

“প্রত্যেক মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে… মাতৃত্ব ও শৈশব বিশেষ সুরক্ষা ও সহায়তার দাবিদার।”

গাজার অবরোধ ভেঙে খাদ্য-ঔষধ প্রবেশের ব্যবস্থা শুরু থেকেই জরুরি ছিল—যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে নয়।

ইতিহাস একদিন কঠোর ভাষায় বিচার করবে সেই দেশগুলোকে যারা এই ভয়াবহতা থামাতে ব্যর্থ হয়েছে বা এতে সহযোগী ছিল—ঠিক যেমন আজ আমরা নাৎসি জার্মানির নৃশংসতা স্মরণ করি।

কেউ কি পুড়ে যাওয়া, ছিন্নভিন্ন শিশুর মৃতদেহ দেখে নীরব থাকতে পারে? অপুষ্টিতে হাড় বের হয়ে যাওয়া শিশুদের দেখে কি কোনো হৃদয় অশ্রুহীন থাকতে পারে? তাহলে ‘সভ্য বিশ্ব’-এর নেতারা কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে মানবিকতা আশা করা যায় না। কিন্তু কানাডার মার্ক কারনি, ব্রিটেনের কির স্টারমার, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ?

এই দেশগুলো সম্প্রতি জনমতের চাপে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু যদি তারা সত্যিই আন্তরিক হয়, তবে অবিলম্বে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ইসরায়েলকে বেসামরিক নির্বিচার বোমাবর্ষণ ও গণঅনাহার বন্ধ করতে বাধ্য করা উচিত।

পৃথিবী ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ব্যর্থ করেছে—আর ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সেই ব্যর্থতা নগ্নভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে বিশ্বকে অবিরাম কাজ করে যেতে হবে।

রবার্ট ফ্যানটিনা, মার্কিন লেখক ও মানবাধিকার কর্মী
এই প্রবন্ধটি বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে “যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী হামলার শিকার শিশু” শীর্ষক সম্মেলনে উপস্থাপিত হয়, যা আয়োজন করে হাবিলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (ইরানের সন্ত্রাসী হামলায়–শহীদ পরিবারদের সংগঠন)।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha